বরিশাল-ভোলায় মগের মুল্লুক, প্রশাসন নির্বিকার…

মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯ | ৮:২০ অপরাহ্ণ |

বরিশাল-ভোলায় মগের মুল্লুক, প্রশাসন নির্বিকার…
প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য ও ছবিতে ডেস্ক রিপোর্ট

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ

বরিশাল-ভোলা সীমানার মেঘনা নদীতে জেগে ওঠা চরে সামছু-তারেক বাহিনীর সন্ত্রাসে গৃহহীন হয়ে পড়েছে দুই জেলার শত শত মানুষ। এমনকি জেলা দুটির মেহেন্দিগঞ্জ ও ভোলা সদর অংশের সীমানা নির্ধারণ করতে পারছে না প্রশাসন। অন্যদিকে আধিপত্য বিস্তার ও পাঁচ হাজার একর চরের বিশাল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে লাঠিয়াল বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্যের দুটি দল বিভিন্ন সময়ে অস্ত্রসহ ভয়ার্ত রূপে মহড়া দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। হামলা-মামলা করে কৃষক ও জমির মালিকদের তাড়িয়ে মহিষ পালন করা হয় সেখানে।


এদিকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে, এলাকা ছেড়ে ঢাকা কিংবা বরিশাল শহরে ভাড়া বাড়িতে থাকেন অনেকে। আবার কেউ কেউ বস্তিতে ও সরকারি ‘আশ্রয় প্রকল্পে’ বসবাস করছেন। এই দুই সন্ত্রাসীর সাম্রাজ্যের মধ্যকার নদীতে মাছ ধরতে হলে কোটি টাকা দাদন দিতে হয় জেলেদের। অন্যথায় জলদস্যুদের দিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে কুপিয়ে-পিটিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ ও প্রশাসন এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না।

অন্যদিকে এসব ঘটনায় বেশির ভাগ সময় থানায় মামলা নেওয়া হয় না। তাই নির্যাতনের শিকার মানুষ থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ নিয়ে যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন এলাকা হওয়ায় দুই জেলার ডিসিদের কাছে একাধিকবার আবেদন করেও সীমানা নির্ধারণ ও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে জমির কৃষক ও মালিকদের মুক্তি মিলছে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এই দুই জেলার সীমান্তে সত্যিকার অর্থেই মগের মুল্লুক কায়েম হয়েছে।


প্রতিদিনের সংবাদের অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা গেছে, বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা ও ভোলা সদর সীমানায় মেঘনা নদীতে ৫ হাজার একর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চর জেগে উঠেছে। দুই জেলার প্রায় ১ লাখ সাধারণ মানুষের অংশীদারত্ব রয়েছে এতে। মেহেন্দিগঞ্জ গোবিন্দপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা সামছুউদ্দিন গাজী ও তারেকের দুটি লাঠিয়াল গ্রুপ রয়েছে। চরের কৃষক অংশীদারদের কাউকেই আসতে দেয় না ওই গ্রুপ দুটি। যারা টাকা দেয় তাদের সীমানা নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকতে দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে যারা মহিষ বা গরু পালন করে এক জোড়া মহিষ-গরু লালন-পালনের জন্য বার্ষিক ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। আর কেউ কৃষিকাজ করলে প্রতি দেড় একর জমিতে স্থানভেদে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাদন নেয়।

চর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সাহেব আলী, বাচ্চু মাঝি, আবুল কালাম, মেঘা চরের জাহাঙ্গীর আকন, সালু ঢালী, কাশেম ঘোষ, হুমায়ুন জমাদ্দার, নোয়াখালী এলাকার গোধা নামের এরা সবাই কয়েক হাজার মহিষ পালন করেন। তারা প্রত্যেকে সামছু ও তারেকের কাছে মহিষ পালনে প্রতি জোড়া বাবদ টাকা পরিশোধ করেন। মেহেন্দিগঞ্জের সীমানার কাছে ‘চরলতা’ চরে মহিষের কিল্লার দায়িত্বে থাকা আবুল হোসেন (ছদ্মনাম) বলেন, তার মালিক গোধা ভাইয়ের বাড়ি নোয়াখালী। প্রতি জোড়া মহিষ পালনের জন্য সামছু বাহিনীকে প্রতি বছর ৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়। তা না হলে মহিষ পালন করা সম্ভব নয়। সামছু-তারেক বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ডার হিসেবে ত্রাসে সক্রিয় অংশ নেয়, জয়নাল, মেম্বর কৃষ্ণ মজুমদার, অহিদ সরদার, তারেকের খালাতো ভাই মোশারেফ, আলমগীর, রাসেল, রাকিব। গোবিন্দপুরের আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকা অধিকাংশ যুবকের এবং উলানিয়া-পাতারহাট এলাকার বেকার যুবকদের ব্যবহার করে এ লাঠিয়াল বাহিনীতে। কয়েকটি স্পটে চরের মধ্যকার ছোট ছোট নদীর মতো রয়েছে। জোয়ারে মাছ ঢুকে পড়ে সেখানে। একেক মৌসুমে ৫০ লাখ টাকা করে দাদন দিয়ে মাছ ধরতে হয় জেলেদের। ১২-১৩টি ইলিশের মাছ ঘাটও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। এ ছাড়া কৃষি মৌসুম এলেই কৃষকের ধান-সবজি কেটে নিয়ে যায় তারা। এই সন্ত্রাসের নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ বছরের ইতিহাস।


এর আগে চর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত আলতু সরদারের লাঠিয়ালগ্যাং। সেসময় ওই দলের সদস্য হিসেবে হাতেখড়ি নেয় সামছু। তিনি মারা যাওয়ার পর সম্প্রতি তিন বছর যাবৎ এ সম্রাজ্যের হাল ধরেছে, তার স্ত্রী রুমা বেগম ও বড় ছেলে তারেক। সঙ্গে রয়েছে ক্যাডার সামছু সরদার। বর্তমানে রুমা বেগমের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তারেক-সামছু একত্রিত হয়ে আধিপত্য সচল রেখেছে। তথ্যমতে, সামছু মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য।

ভুক্তভোগী মাকছুদা বেগম মেহেন্দিগঞ্জ ও ভোলা সদরের সীমানবর্তী কানি বগা চরে ১০ বছর যাবৎ বসবাস করেন। তিনি বলেন, চরে তারা জমি কিনেছেন। সন্ত্রাসী সামছু ও তারেক দলবল নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করেছেন অনেকবার। চাষাবাদ করার শেষ সম্বল ট্রাক্টর কুপিয়ে আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলেছে। চর ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। এখানে মহিষ পালন করতে চায় তারা। অন্যথায় বার্ষিক জমির শতাংশ অনুযায়ী চাঁদা দিতে হবে। এভাবে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। থানা পুলিশও মামলা নেয় না। আমাদের সামর্থ্যও নেই মামলা করার। বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।

একই চরে বসবাসকারী জহুর আলী ব্যাপারী বলেন, জীবিকার দায়ে চরে এসে গরু পালন শুরু করেছি। প্রতি জোড়া পালনে বছরে ৫ হাজার টাকা করে চাচ্ছে সামছু ও তারেক বাহিনী। টাকা দিতে পারিনি বলে কয়েক দিন আগে আমাকে পিটিয়ে গেছে। যখন আসে, তখন তাদের সঙ্গে দা অস্ত্রসহ আসে টলার ভরে বাহিনীর কয়েকশ লোক আসে। এর আগেও টাকা দিতে পারিনি বলে আমার দুটি গরু তাদের গোবিন্দপুর ক্যাম্পে নিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলেছে। প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ নেই। রিয়াজ বরিশালে ভাড়া বাসায় থাকেন। তাদের পিতৃভিটা ছিল মেহেন্দিগঞ্জ জেগে ওঠা চরে। তার বাবা ও চাচাদের বংশের প্রায় ৫০০ একর জমি রয়েছে সেখানে। অথচ সামছু ও আলতু সরদারের ছেলে তারেক সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হুমকি দিচ্ছে। জমির মালিক ও কৃষক জমি ভোগ করতে গেলে তাদের ওপর হামলা করে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়। ভীতিকর পরিস্থিতির কারণে আমরা বংশের কেউ চরের জমি ফসল চাষ কিংবা বসবাস করতে যাচ্ছি না।

অপর এক ভুক্তভোগী কাশেম বরিশালে বসবাস করেন। তিনি জানান, তার বাপ-দাদার প্রায় ২০০ একর জমি রয়েছে চরের বিভিন্ন মৌজায়। জমি ভোগ করতে পারি না। সম্প্রতি ৫০-৬০ জন লোক নিয়ে চরে শুধু জমি দেখতে গিয়েছিলাম। খবর এসেছে সামছু বাহিনী ধাওয়া করে আসতেছে। তাই জমি না দেখেই ফিরে আসি। ভোলার কিছু লোকও ওই জমির কিছু অংশ ভোগ করে বলে তিনি প্রতিদিনের সংবাদের কাছে বলেন। একই ঘটনার স্বীকার সফিজ উদ্দিন চকিদার, রাজা, অলি, মন্নাফসহ হাজার হাজার মানুষ। এসব বিষয়ে লাঠিয়াল গ্যাংপ্রধান সামছু জানান, তিনি চরে আসা-যাওয়া করেন, মানুষ যাতে ভালো থাকেন। তার বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে দাবি করেন।

একই বিষয়ে লাঠিয়ালের অপর নেতা তারেক সরদারের কাছে জানতে গেলে তিনি তার ঘরের দরজা বন্ধ করে কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পরে মোবাইল ফোনের লাইন কেটে দেন। মেহেন্দিগঞ্জ গোবিন্দপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন তালুকদার জানান, তার ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে আছে। সীমানা নির্ধারণ না হওয়ায় চরে হাঙ্গামা লেগেই থাকে। তবে অজ্ঞাত কারণে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি মুখ খুলতে চাইছেন না।

ভোলা রাজাপুরের সাবেক ইউপি সদস্য ওহাব আলী বলেন, চরের জমিতে সাধারণ মানুষ ভিড়তে পারে না। পিটিয়ে-কুপিয়ে নদীতে ফেলে দেয়। তাই আমরা এলাকার মানুষ সেখানে যাচ্ছি না। ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজান খান বলেন, চরের জমিতে তার এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষের অংশীদারত্ব আছে। তার নিজেরও জমি রয়েছে। চাষাবাদ কিংবা বসবাস করতে গেলে মেহেন্দিগঞ্জের সামছু ও তারেক সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে হামলা করে। মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়।

বরিশাল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাইদুল ইসলাম জানান, সন্ত্রাসীরা চর দখল করে আছে। ওদের কারণে দিন-তারিখ নির্ধারণ হওয়ার পরও ভোলা-বরিশালের সীমানা নির্ধরণ করা সম্ভব হয়নি। বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম জানান, লাঠিয়াল বাহিনী ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নজরদারি রয়েছে। তবে চর এলাকার সীমানা নির্ধারণ না হওয়ার কারণে ব্যবস্থা নিতে সমস্যা হচ্ছে। দুই জেলার ডিসি এ সমস্যা সমাধান করবেন।

ভোলা জেলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কাওছার হোসেন এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল কি না, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান। বরিশাল জেলার ডিসি এস এম অজিয়র রহমান জানান, দুই জেলার সীমানা নির্ধারণ নিয়ে কোনো বিষয় থাকলে সেটা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আবেদন করতে হবে। বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. ইয়ামিন চৌধুরী জানান, বরিশাল-ভোলা জেলার মেহেন্দিগঞ্জ অংশের সীমানা নিয়ে বিরোধের কথা শুনেছি। এ সমস্যা সমাধানে দরকারি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আপনার মুল্যবান মতামত দিন......

comments

প্রধান কার্যালয়: শিমুল লজ, ১২/চ/এ/২/৪ (২য় তলা), রোড নং ৪, শেরেবাংলা নগর,শ্যামলী,ঢাকা‌.
বার্তা বিভাগ-01763234375 অথবা 01673974507, ইমেইল- sangbadgallery7@gmail.com

আঞ্চলিক কার্যালয়: বঙ্গবন্ধু সড়ক, আধুনিক সদর হাসপাতাল সংলগ্ন, বাসস্ট্যান্ড, ঠাকুরগাঁও-৫১০০

2012-2016 কপি রাইট আইন অনুযায়ী সংবাদ-গ্যালারি.কম এর কোন সংবাদ ছবি ভিডিও কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথায় প্রকাশ করা আইনত অপরাধ

Development by: webnewsdesign.com